Friday, 2 June 2017

দ্বাদশ অধ্যায়ঃ ভক্তিযোগ


অর্জুন উবাচ
এবম্‌ সতত যুক্তাঃ যে ভক্তাঃ ত্বাম্‌ পর্যুপাসতে ।
যে চ অপি অক্ষরম্‌ অব্যক্তম্‌ তেষাম্‌ কে যোগ-বিত্তমাঃ ।।১
অর্থ-অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন-হে ভগবান এই ভাবে নিরন-র ভক্তিযুক্ত হয়ে যারা সমাহিত চিত্তে তোমার আরাধনা করে এবং যারা ইন্দ্রিয়াতিত অব্যক্ত ব্রহ্মের উপাসনা কওে, তাদের মধ্যে কারা শ্রেষ্ঠযোগী।

ভগবান উবাচ
ময়ি আবেশ্য মনঃ যে মাম্‌ নিত্য যুক্তা উপাসতে ।
শ্রদ্ধায়া পরয়া উপেতাঃ তে মে যুক্ততমাঃ মতাঃ ।।২
অর্থ-ভগবান বললেন-যিনি আমার সবিশেষ রূপে তার মনকে নিবিষ্ট করেন, অপ্রাকৃত ভক্তি সহকারে নিরন-র উপাসনা করেন আমার মতে তারাই শ্রেষ্ঠ যোগী।

যে তু অক্ষরম্‌ অনির্দেশ্যম্‌ অব্যক্তম্‌ পর্যুপাসতে ।
সর্বত্রগম্‌ অচিন্তম্‌ চ কুটস্তম্‌ অচলম্‌ ধ্রূবম্‌ ।৩

সংনিয়ম্য ইন্দ্রিয়-গ্রামম্‌ সর্বত্র সমবুদ্ধয়ঃ ।
তে পাপ্নুবন্তি মাম্‌ এব সর্বভূতহিতে রতাঃ ।।৪
অর্থ-যারা সমস্ত ইন্দ্রিয় সংযত কওে, সকলের প্রতি সমভাবপন্না হয়ে সর্বভূতের কল্যাণে রত হয়ে আমার অক্ষর,অনির্দেশ্য,অব্যক্ত সর্বত্রগ,অচিন্ত্য,কুটস্থ, অচল,ধ্রুব ও নির্বিশেষ স্বরুপকে উপসনা করেন,তারা অবশেষে আমাকেই লাভ করে।

ক্লেশ অধিকতরঃ তেষাম্‌ অব্যক্ত আসক্ত চেতসাম্‌ ।
অব্যক্তা হি গতিঃ দুঃখম্‌ দেহবদ্ভীঃ অবাপ্যতে ।।৫
অর্থ-যাদের ভগবানের অব্যক্ত নির্বেশেষ রুপের প্রতি আসক্ত তাদের পক্ষে পারমার্থিক লাভ করা অত্যন্ত কষ্টকর। কারন অবক্তের উপাসনার ফলে দুঃখই লাভ হয়।

যে তু সর্বানি কর্মানি ময়ি সংন্যস্য মত্পরাঃ ।
অনন্যেন এব যোগেন মাম্‌ ধায়ন্ত উপাসতে ।।৬

তেষাম্‌ অহম্‌ সমুদ্ধর্তা মৃত্যু সংসার সাগরাত্ ।
ভমামি ন চিরাত্ পার্থ ময়ি আবেশিত চেতসাম্‌ ।।৭
অর্থ-হে পার্থ, যারা সমস্ত কর্ম আমাতে সমর্পন করে মত্পরায়ন হয়ে অনন্য ভক্তিযোগের দ্বারা আমার উপসনা ও ধ্যান করেন, সেই সমস্ত ভক্তদের আমি অচিরেই সংসার থেকে উদ্ধার করি।

ময়ি এব মনঃ অধত্স্ব ময়ি বুদ্ধিম্‌ নিবেশয় ।
নিবসিষসি ময়ি এব অতঃ উর্ধ্যম্‌ ন সংশয়ঃ ।।৮
অর্থ-অতএব আমাতেই তুমি মন সমাহিত কর, আমাতেই বুদ্ধি নিবিষ্ট কর। তার কারন তুমি নিশ্চই আমাকে প্রাপ্ত হবে। সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই।

অথ চিন্তম্‌ সমাধাতুম্‌ ন শক্লোসি ময়ি স্থিরম্‌ ।
অভ্যাস যোগেন ততঃ মাম্‌ ইচ্ছা আপ্তুম্‌ ধনঞ্জয় ।।৯
অর্থ-হে ধনঞ্জয়, যদি তুমি আমাতে চিত্ত সমাহিত করতে না পার, তাহলে অভ্যাস যোগ দ্বারা আমাকে লাভ করতে চেষ্টাকর।

অভ্যাসে অপি অসমর্থঃ অসি মত্ কর্ম পরমভব ।
মদর্থম অপি কর্মানি কুর্বান সিদ্ধিম্‌ অবাস্পসি ।।১০
অর্থ-যদি তুমি এই ভাবে অভ্যাস করতে অসমর্থ হও, তাহা হলে আমার জন্য কর্ম করতে চেষ্টা কর কারন আমার জন্য কর্ম করতে করতেই তুমি ক্রমে সিদ্ধিলাভ করবে।

অথ এতত্ অপি অশক্তঃ অসি কর্তুম্‌ যোগম্‌ আশ্রিতঃ ।
সর্ব কর্ম ফল ত্যাগম্‌ ততঃ কুরু যতাত্মবান ।।১১
অর্থ-আর যদি তাও করতে অক্ষ্যম হও, তবে আমাতে সমস্ত কর্ম অর্পন করে কর্মের ফল ত্যাগ কর।

শ্রেয় হি জ্ঞানম্‌ অভ্যাস্যাত্ জ্ঞানাত্ ধ্যানম্‌ বিশিষ্যতে ।
ধ্যানাত্ কর্মফল ত্যাগঃ ত্যাগাত্ শান্তি অন্তরম্‌ ।।১২
অর্থ-তুমি যদি সেই প্রকার অভ্যাসে সক্ষম না হও,তা হলে জ্ঞানের দ্বারা অনুশিলন কর। জ্ঞান থেকে ধ্যান শ্রেষ্ঠ, এবং ধ্যান থেকে কর্ম ফল ত্যাগ শ্রেষ্ঠ, কারন এই প্রকার কর্মফল ত্যাগে পরম শান্তি লাভ হয়।

অদ্ধেষ্টা সর্বভূতানাম্‌ মৈত্র করণঃ এব চ ।
নির্মম্‌ নিরহঙ্কারঃ সম্‌ দুঃখ সুখ ক্ষমী ।।১৩

সন্তুষ্টঃ সততম্‌ যোগী যতাত্মা দৃঢ়নিশ্চয় ।
ময়ি অর্পিত মনঃ বুদ্ধিঃ যঃ মত্ভক্তঃ স মে প্রিয়ঃ ।।১৪
অর্থ-যিনি সমস্ত জীবের প্রতি দ্বেষ শুন্য, বন্ধুভাবাপন্য, দয়ালু, মমতাবুদ্ধিশুন্য, নিরহঙ্কার, সুখ দঃুখ্য সমভাবাপন্য সর্বদা সন্তুষ্ট সবসময় ভক্তিযোগে যুক্ত, সংযত স্বভাব, তত্তবিষয় দৃঢ় নিশ্চয় এবং যার মন ও বুদ্ধি সর্বদা আমাতে অর্পিত তিনি আমার প্রিয় ভক্ত।

যস্মাত্ ন উদ্বিজতে লোকঃ লোকাত্ ন উদ্বিজতে চ যঃ ।
হর্ষ অমর্ষ ভয় উদ্বেগৈঃ মুক্তঃ যঃ সঃ চ মে প্রিয়ঃ ।।১৫
অর্থ-যার থেকে কেউ উদ্বেগপ্রাপ্ত হন না এবং যিনি কারোর দ্বারা উদ্বেগ প্রাপ্ত হননা; যিনি হর্ষ, বিষাদ, ভয় ও উদ্বেগ থেকে মুক্ত তিনি আমার প্রিয়।

অনপেক্ষঃ শুচিদক্ষঃ উদাসীনঃ গতব্যথঃ ।
সর্বারম্ভা পরিত্যাগী যঃ মদ্ভক্তঃ সঃ মে প্রিয় ।।১৬
অর্থ-যিনি নিস্পৃহ, শুচি, দক্ষ, পক্ষপাতশুন্য, ভয়হীন এবং স্বকাম কর্মের অনুষ্ঠান ত্যাগী, তিনি আমার প্রিয় ভক্ত।

যঃ ন হৃষ্যতি ন দ্বেষ্টি ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি ।
শুভ অশুভ পরিত্যাগী ভক্তিমান যঃ সঃ মে প্রিয় ।।১৭
অর্থ-যিনি আকাঙ্ক্ষিত বস্তুর প্রাপ্তিতে হৃষ্ট হননা, এবং অনিষ্ট প্রাপ্তিতে দ্বেষ করেন না, প্রিয় বিয়োগে শোক করেন না, অপ্রাপ্ত ইষ্ট বস্তুর আকাঙ্ক্ষা করেন না এবং শুভাশুভ সমস্ত কর্ম পরিত্যাগ করেছেন তিনি আমার প্রিয়।

সমঃ শত্রৌ চ মিত্রে চ তথা মান অপমানয়ঃ ।
শীত উষ্ণ সুখ দুঃখেষু সমঃ সঙ্গবিবর্জিত ।।১৮

তুল্য নিন্দা স্তুতিঃ মৌনী সন্তুষ্টঃ যেন কেন চিত্ ।
অনিকেতঃ স্থির মতিঃ ভক্তিমান মে প্রিয় নরঃ ।।১৯
অর্থ-যিনি শত্রু মিত্রের মধ্যে সমবুদ্ধি, যিনি সম্মান অপমানে অবিচালিত, যিনি শীতোষ্ণজনিত সুখে দুঃখে, নির্বিকার স্থির বুদ্ধি নিন্দা ও স্তুতিতে সমবুদ্ধি; সংযত বাক্‌, যত্কিঞ্চিত্ লাভে সন্তষ্ট, গৃহাসক্তিশুন্য এবং আমার প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত; সে ভক্ত আমার অত্যন্ত প্রিয়।

যে তু ধর্ম অমৃতম্‌ ইদম্‌ যথা উত্তম্‌ পর্যুপাসতে ।
শ্রদ্দাধ্যানাঃ মত্পরমাঃ ভক্তাঃ তে অতীব মে প্রিয়াঃ ।।২০
অর্থ-আমার প্রতি শ্রদ্ধা সহকারে যারা আমার প্রদর্শিত ধর্মামৃতে উপসনা করেন, তারাই আমার ভক্ত, তাই তারা আমার অত্যন্ত প্রিয়।

একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরুপ দর্শন যোগ

অর্জুন উবাচ

মদনুগ্রহায় পরমম্‌ গুহ্যম্‌ আধ্যাত্ম সংজ্ঞিতম্‌ ।
যত্ তয়া উত্তম্‌ বচঃ তেন মোহঃ অয়ম্‌ বিগতঃ মম্‌ ।।১
অর্থ-আমার প্রতি অনুগ্রহ করে তুমি যে আধ্যাত্ম তত্ত্ব সম্বন্ধিয় পরম গুহ্য উপদেশ আমাকে দিয়েছ, তার দ্বারা আমার মোহ দুর হয়েছে।

ভব অপ্যয়ৌ হি ভূতানাম্‌ শ্রুতৌ বিস্তরশঃ ময়া ।
ত্বত্তঃ কমলপত্রাক্ষ মাহাত্মম্‌ অপি চ অব্যয়ম্‌ ।।২
অর্থ-হে পদ্মপলাশ লোচন সর্বভূতের উত্পত্তি ও প্রলয় তোমার থেকেই হয়, তোমার কাছ থেকেই আমি তোমার অব্যয় মাহাত্ম অবগত হলাম।

এবম্‌ এতত্ যথাত্থ ত্বম্‌ আত্মানাম্‌ পরমেশ্বর ।
দ্রষ্টুম্‌ ইচ্ছামি তে রুপম্‌ ঐশ্বরম্‌ পুরুষোত্তম্‌ ।।৩
অর্থ-হে পুরুষত্তম তুমি যে আত্ত তত্ত্ব বলেছ তা যথার্থ। কিন্তু তা সত্তেও হে পরমেশ্বর তুমি যে ভাবে এই বিশ্বে প্রবেশ করেছ, আমি তেমার সেই ঐশ্বরীরুপ দেখতে ইচ্ছা করি।
মন্যতে যদি তত্ শক্যম্‌ ময়া দ্রষ্টুম্‌ ইতি প্রভো ।
যোগেশ্বরম্‌ ততঃ মে ত্বম্‌ দর্শয় আত্মানাম্‌ অব্যয় ।।৪
অর্থ-হে প্রভু, তুমি যদি মনে কর যে আমি তোমার এই বিশ্বরুপ দর্শন করার যোগ্য, তা হলে হে যোগেশ্বর আমাকে তেমার সেই জগতাত্ম রুপ দেখাও।

=ঃভগবান=উবাচঃ=
পশ্য মে পার্থ রুপাণী শতশঃ অথ সহস্রশঃ ।
নানাবিধানি দিব্যানি নানা বর্ন আকৃতীনি চ ।।৫
অর্থ-ভগবান বললেন-হে পার্থ নানা বর্ন ও নানা আকৃতি বিশিষ্ট শতশত এবং সহস্র সহস্র আমার বিভিন্ন দিব্য মূর্তি দর্শন কর।

পশ্য আদিত্যান্‌ বসুন রদ্রান অশ্নিনৌ মরুতঃ তথা ।
বহুনী অদৃষ্ট পুর্বানি পশ্য আশ্চর্যানি ভারত ।।৬
অর্থ-হে ভারত, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, অশ্বিনিকুমারদয়, উনপঞ্চাশ মরুত এবং অনেক অদৃষ্টপুর্ব আশ্চার্যরুপ দেখ।

ইহ একস্থম্‌ জগত্ কৃত্স্নম্‌ পশ্য অদ্য স চর অচরম্‌ ।
মম্‌ দেহে গুড়াকেশ যত্ চ অন্যত্ দ্রষ্টুম্‌ ইচ্ছসি ।।৭
অর্থ-হে-অর্জুন, আমার এই বিরাট শরিরে অবয়ব রুপে একত্রে অবস্থিত সমগ্র স্থাবর জঙ্গমাত্ম বিশ্ব এবং অন্য যা কিছু দেখতে ইচ্ছা কর আজ দর্শন কর।

ন তু মাম্‌ শক্যসে দ্রষ্টুম অনেন এব স্বচক্ষুষা ।
দিব্যম্‌ দদামি তে চক্ষুঃ পশ্য মে যোগমৈশ্বরম ।।৮
অর্থ-তুমি তোমার চক্ষুদ্বারা আমার বিশ্বরুপ দর্শন করতে পারবে না। তাই আমি তোমাকে দিব্য চক্ষুদান করছি যার দ্বারা তুমি তোমার অচিন্ত যোগৈশ্বর্য্য দর্শন করতে পারবে।
সঞ্জয় উবাচ
এবম উক্তা ততঃ রাজন মহাযোগেশ্বরঃ হরিঃ ।
দর্শয়মাস পার্থায় পরমম্‌ রুপম ঐশ্বরম্‌ ।।৯
অর্থ-সঞ্জয় বললেন হে রাজন এই ভাবে বলে, মহান যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তার অলৌকিক বিশ্বরুপ দেখালেন।

অনেক বক্ত্র নয়নম্‌ অনেক অদ্ভুত দর্শনম্‌ ।
অনেক দিব্য আভরনম্‌ দিব্য অনেক উদ্যত আয়ুধম্‌ ।।১০
দিব্য মাল্য অম্বরধরম্‌ দিব্য গন্ধ অনুলেপনম্‌ ।
সর্ব আশ্চর্য্যময়ম্‌ দেবম্‌ অনন্তম্‌ বিশ্বতোমুখম্‌ ।।১১
অর্থ-অর্জুন দেখলেন সেই বিশ্বরুপ অনেক মুখ অনেক নেত্রযুক্ত, অনেক অদ্ভুত আকৃতি ও অসংখ্য দিব্য অলংঙ্কার বিশিষ্ট এবং অনেক উদ্যত দিব্য অস্ত্রে সজ্জিত। সেই বিশ্বরুপ দিব্য মালা ও দিব্য বস্ত্রে ভূষিত, দিব্য গন্ধদ্বারা অনুলিপ্ত, অত্যন্ত আশ্চর্য্যজনক জোর্তিময় অনন্ত ও সর্বতোমুখ বিশিষ্ট।

দিবি সুর্য্য সহস্রস্য ভবেত্ যুগপত্ উত্থিতা ।
যদি ভাঃ সদৃশী সা সাত্ ভাসঃ তস্য মহাত্মনঃ ।।১২
অর্থ-যদি আকাশে সহস্র সুর্য্যেও প্রভা উদিত হয় তা হলে সেই দীপ্তি বিশ্বরুপের প্রভাব কিঞ্চিত্ তুল্য হতে পারে।

তত্র একস্থম্‌ জগত্ কৃত্স্নম্‌ প্রবিভক্তম্‌ অনেকধা ।
অপশ্যত্ দেবদেবস্য শরীরে পান্ডব তদা ।।১৩
অর্থ-তখন অর্জুন পরমেশ্বর ভগবানের বিশ্বরুপে নানাভাবে বিভক্ত সমগ্র জগত্ একত্রে অবস্থিত দেখলেন।
ততঃ সঃ বিস্ময়াবিষ্টাঃ হৃষ্টরোমা ধনঞ্জয় ।
প্রণম্য শিরসা দেবম্‌ কৃতাঞ্জলিঃ অভাষত ।।১৪
অর্থ-অর্জুন সেই বিশ্বরুপ দর্শন করে আশ্চর্যান্বিত ও রোমাঞ্চিত হলেন এবং অবনত মস-কে ভগবানকে প্রনাম করে কর জোরে বললেন।

অর্জুন উবাচ
পশ্যামিদেবান তব দেহে
সর্বান তথা ভূত বিশেষ-সঙ্ঘান ।
ব্রহ্মানম্‌ ঈশম কমলাসনস্থম
ঋষীন চ সর্বান উরগান ন চ দিব্যম্‌ ।।১৫
অর্থ-অর্জুন বললেন হে দেব, তোমার এই বিশ্বরুপে সমস্ত দেবতা, চরাচর জগত্ ঋষীদের, সর্পসমুহ এবং সৃষ্টিকর্তা কমলাসনা ব্রহ্মকে দেখছি।

অনেক বাহু উদর বক্ত্র নেত্রম্‌
পশ্যামি ত্বাম সর্বতঃ অনন্তরূপম্‌ ।
ন অন্তম্‌ ন মধ্যম্‌ ন পুনঃ তব আদিম্‌
পশ্যামি বিশ্বেশর বিশ্বরূপ ।।১৬
অর্থ-হে জগত্ ঈশ্বও, সর্বত্র বহু বাহু, বহু উদও, বহু মুখ ও বহু নেত্রবিশিষ্ট তোমার বিশ্বরুপ আমি দেখছি। হে ভগবান তোমার আদি, মধ্য ও অন্ত দেখছি না।

কিরীটিনম্‌ গদিনম্‌ চক্রিনম্‌ চ
তেজোরাশিম্‌ সর্বতঃ দীপ্তিমন্তম্‌ ।
পশ্যামি ত্বাম্‌ দুর্নিরীক্ষ্যম্‌ সমন্তাত্
দীপ্ত-অনল অর্ক দ্যুতিম্‌ অপ্রমেয় ।।১৭
অর্থ-কিরীট গদা ও চক্রধারী, সর্বত্র দিপ্তীমান, তেজঃপুঞ্জ স্বরুপ দুনিরীক্ষ্য প্রদীপ্ত অগ্নি ও সুর্য্যের মত প্রভাবিশিষ্ট এবং অপ্রমেয় স্বরুপ তোমাকে আমি সর্বত্র দেখছি।

ত্বম্‌ অক্ষরম্‌ পরমম্‌ বেদিত্যবম্‌
ত্বম অস্য বিশ্বস্য পরম্‌ নিধানম ।
ত্বম্‌ অব্যয়ঃ শাশ্বতধর্মগোপ্ত
সনাতনঃ ত্বম পুরুষঃ মতঃ মে ।।১৮
অর্থ-তুমি পরম ব্রহ্ম এবং এক মাত্র জ্ঞাতব্য। তুমি বিশ্বের পরম আশ্রয় ও সনাতন ধর্মের রক্ষক, তুমিই সনাতন এই আমার অভিমত।

অনাদি মধ্যান্তম্‌ অনন্ত বীর্যম
অনন্ত বাহু শশিসুর্য নেত্রম্‌ ।
পশ্ব্যামি ত্বাম্‌ দীপ্ত হুতাশবক্ত্রম্‌
স্বতেজসা বিশ্ব্যম্‌ ইদম্‌ তপন্তম্‌ ।।১৯

দ্যৌ আপৃথিব্যোঃ ইদম্‌ অন-রম্‌ হি
ব্যাপ্তম্‌ ত্বয়া একেন দিশঃ চ সর্বাঃ ।
দৃষ্টা অদ্ভুতম্‌ রূপম্‌ উগ্রম্‌ তব ইদম্‌
লোকত্রয়ম্‌ প্রব্যথিতম্‌ মহাত্মন্‌ ।।২০
অর্থ-আমি দেখছি তোমার আদি নেই, তুমি অনন্ত শক্তিশালী ও অসংখ্য বাহু বিশিষ্ট চন্দ্র-সুর্য্য তোমার চক্ষুদ্বয়; তোমার মুখ মন্ডল প্রদীপ্ত অগ্নির জ্যোতি এবং তুমি স্বীয়তেজে সমস্ত জগত্ সন্তপ্ত করছ। হে ভগবান স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যবর্তি অন্তরীক্ষ্য এবং দশদিক পরিব্যাপ্ত করে আছ। তোমার এই অদ্ভুত ভয়ঙ্কর বিশ্বরুপ দর্শন করে ত্রিলোক অত্যন্ত ভীত হচ্ছে।

অমী হি ত্বাম্‌ সুরসংঙ্ঘাঃ বিশন্তি
কোচিত্ ভীতাঃ প্রাঞ্জলয়ঃ গৃনন্তি ।
স্বস্তি ইতি উক্তা মহর্ষি সিদ্ধসঙ্ঘাঃ
স্তুবন্তি ত্বাম্‌ স্তুতিভিঃ পুস্কলাভিঃ।২১
অর্থ-সমস্ত দেবতারা তোমাতেই প্রবেশ করছেন। কেউ কেউ ভীত হয়ে করজোরে তোমার গুনগান করছেন এবং মহর্ষী ও সিদ্ধি পুরুষগন জগতের কল্যান হউক বলে প্রচুর স্তুতি বাক্যের দ্বারা তোমার স্তব করছে।

রুদ্র আদিত্যাঃ বসবঃ যে চ সাধ্যাঃ
বিশ্বে অশ্বিনৌ মরুতঃ চ উষ্মপাঃ চ ।
গন্ধর্ব যক্ষ অসুরসিদ্ধসংঙ্ঘাঃ
বিক্ষন্তে ত্বাম বিস্মিতাঃ চ এব সর্বে ।।২২
অর্থ-রুদ্রগন, আদিত্যগন, সাধ্য নামক দেবতারা,বসুগন,বিশ্বদেবতাগন, অশ্বিনিকুমারদ্বয়, মরুতগন, পিত্রীগন, যক্ষ্যগন, অসুরগন এবং সিদ্ধগন সকলেই বিস্মৃত হয়ে তোমাকে দর্শন করছে ।

রূপম্‌ মহত্ তে বহু বক্ত্র নেত্রম্‌
মহাবাহো বহু বাহু উরু পাদম্‌ ।
বহুদরম্‌ বহুদংষ্ট্রা করালম্‌
দৃষ্ট্রা লোকাঃ প্রব্যথিতাঃ তথা অহম্‌ ।।২৩
অর্থ-মহাবাহো, বহু মুখ, বহু চক্ষু, বহুবাহু , বহু উরু, বহু চরন এবং বহু উদর বিশিষ্ট এবং অসংখ্য দন্তের দ্বারা ভীষন তোমার বিগ্রহ দর্শন করে সমস্ত প্রাণী অত্যন্ত ভীত হচ্ছে এবং আমি ও অত্যন্ত ভীত হচ্ছি।

নভঃস্পৃশম্‌ দীপ্তম্‌ অনেক বর্নম্‌
ব্যাত্ত আননম দীপ্ত বিশাল নেত্রম্‌ ।
দৃষ্টা হি ত্বাম্‌ প্রব্যথিত অন্তরাত্মা
ধৃতিম্‌ ন বিন্দামি শমম্‌ চ বিষ্ণো ।।২৪
অর্থ-বিষ্ণো তোমার আকাশ স্পর্শি তেজময় নানা বর্নযুক্ত বিস্ময় হেতু মুখ মন্ডল এবং উজ্জল বিশাল চক্ষু দেখে আমার হৃদয় ব্যাথিত হচ্ছে এবং আমি ধ্যৈর্য্য ও শম অবলম্বন করতে পারছি না।

দংষ্ট্রা করালানি চ তে মুখানি
দৃষ্টা এব কালানল সন্নিভানি ।
দিশঃ ন জানে ন লভে চ শর্ম
প্রসীদ দেবেশ জগনিবাস ।।২৫
অর্থ-হে দেবেশ, ভয়ঙ্কর ও দীর্ঘ দন্তযুক্ত ও প্রলয়াগ্নি তুল্য তোমার মুখ সকল দেখে আমার দিকভ্রম হচ্ছে এবং আমি শান্তি পাচ্ছি না হে জগন্নিবাস, তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও।
অমী ত্বাম ধৃতরাষ্ট্রস্য পুত্রাঃ
সর্বে সহৈব অবনিপাল সঙ্ঘৈঃ ।
ভীষ্মঃ দ্রোনঃ সুত পুত্রঃ তথা অসৌ
সহ অস্মদীয়ৈঃ অপি যোধমুখ্যৈঃ ।।২৬

বক্ত্রানি তে ত্বরমাণাঃ বিশনন্তি
দংষ্ট্রা করালানি ভয়াকানি ।
কোচিত্ বিলগ্নাঃ দশনান্তরেষু
সংদৃশন্তে চুর্নিতে উত্তমাঙ্গৈঃ ।।২৭

যথা নদীনাম্‌ বহবঃ অম্বুবেগাঃ
সমুদ্রম্‌ এব অভিমুখা দ্রবন্তি ।
তথা তব অমী নরলোকবীরা
বিশন্তি বক্ত্রনি অভিবিজ্বলন্তি ।।২৮

যথা প্রদীপ্তম্‌ জ্বলনম্‌ পতঙ্গাঃ
বিশন্তি নাশায় সমৃদ্ধবেগাঃ ।
তথৈব নাশায় বিশন্তি লোকাঃ
তব অপি বক্ত্রানি সমৃদ্ধবেগাঃ ।।২৯

লেলিহ্যসে গ্রসমানঃ সমন্তাত্
লোকান সমগ্রান বদনৈঃ জ্বলদ্ভিঃ ।
তেজোভিঃ আপুর্য জগত্ সমগ্রম্‌
ভাসঃ তব উগ্রাঃ প্রতপন্তি বিষ্ণো ।।৩০
অর্থ-ধৃতরাষ্টের পুত্রেরা ভীস্ম, দ্রন, কর্ন এবং সমস্ত রাজন্য বর্গসহ এবং আমাদের পক্ষ্যের সমস্ত সৈন্যেরা তোমার করাল দন্ত বিশষ্ট মুখের মধ্যে দ্রুতবেগে প্রবেশ করছে এবং সেই দন্ত মধ্যে বিলগ্ন হয়ে তাদের মস্তক চুর্নিত হচ্ছে। নদীসমুহ যেমন সমুদ্রাভিমুখে প্রবাহিত হয়ে দ্রুতবেগে সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায় তেমনই নরলোকের বীর গন তোমার জ্বলন্ত মুখ বিবরে প্রবেশ করছে। পতঙ্গ যেমন দ্রুত গতিতে ধাবিত হয়ে মরনের জন্য জ্বলন্ত অগ্নিতে প্রবেশ করে তেমনই এই সমস্ত মানুষেরাও মৃত্যু জন্য অতি বেগে তোমার মুখ বিবরে প্রবেশ করছে। হে বিষ্ণু তুমি তোমার জ্বলন্তমুখ সমুহের দ্বারা সকল লোককে গ্রাস করছ এবং সমগ্র জগতকে তেজোরাশির দ্বারা আবৃত করে সন্তপ্ত করছ।

আখ্যাহি মে কঃ ভবান উগ্ররূপ
নমহস্তু তে দেববর প্রসীদ ।
বিজ্ঞাতুম্‌ ইচ্ছামি ভবন্তম্‌ আদ্যম্‌
ন হি প্রজানামি তব প্রবৃত্তিম্‌ ।।৩১
অর্থ-উগ্রমুর্তি তুমি কে? আমাকে বল। হে দেবশ্রেষ্ঠ, তোমাকে নমস্কার করি, তুমি প্রসন্ন হও। আমি তোমার প্রবৃত্তি অবগত নই, আমি তেমাকে বিশেষ ভাবে জানতে ইচ্ছা করি।

ভগবান উবাচ

কালঃ অস্মি লোক ক্ষয়কৃত্ প্রবৃদ্ধঃ
লোকান্‌ সমাহর্তুম ইহ প্রবৃত্তঃ ।
ঋতেহপি ত্বাম্‌ ন ভবিশন্তি সর্বে
যে অবস্থিতাঃ প্রত্যনীকেষু যোধাঃ ।।৩২
অর্থ-ভগবান বললেন- আমি লোকক্ষয়কারী কাল। এখন লোক সংহার করতে প্রবৃত্ত হয়েছি তোমারা (পান্ডবেরা) ছাড়া সমস্ত যোধ্যারা ধংস হবে।

তস্মাত্ ত্বম্‌ উত্তিষ্ট যশঃ লভস্ব
জিত্বা শত্রুন ভূঙক্ষু রাজ্যম্‌ সমৃদ্ধম্‌ ।
ময়া এব এতে নিহতাঃ পুর্বমেব
নিমিত্তমাত্রম্‌ ভব সাব্যসাচিব ।।৩৩
অর্থ-অতএব তুমি যুদ্ধকরার জন্য উত্থিত হও ও যশ লাভকর শত্রুদের পরাজিত করে সমৃদ্ধশালী রাজ্য ভোগ কর। আমার দ্বারা এরা পুর্বে নিহত হয়েছে। হে সব্যসাচিব তুমি নিমিত্ত মাত্র হও।

দ্রোনম্‌ চ ভীস্মম্‌ চ জয়দ্রথম্‌ চ
কর্নম্‌ তথা অন্যান্‌ অপি যোধবিরান্‌ ।
যথা হতান্‌ ত্বম্‌ জহি মা ব্যাথিষ্ঠাঃ
যুধ্যস্ব জেতাসি রনে সপত্না্‌ ।।৩৪
অর্থ-ভগবান বললেন - দ্রোন ভীস্ম কর্ন জয়দ্রথ এবং অন্যান্য বীর যোদ্ধাদের আমি নিহত করেছি। তুমি মৃতদেরই বধ কর। তুমি যুদ্ধ কর শত্রুদের নিশ্চয়ই জয় করবে, অতএব যুদ্ধ কর।
সঞ্জয় উবাচ
এতত্ শ্রূত্বা বচনম্‌ কেশবস্য
কৃতাঞ্জলীঃ বেপমানঃ কিরীটী ।
নমস্কৃত্বা ভুয়ঃ এব আহ কৃষ্ণম্‌
সগদগদম্‌ ভীতভীতঃ প্রনম্য ।।৩৫
অর্থ- সঞ্জয় ধৃতরাষ্টকে বললেন -হে রাজন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই বাণী শ্রবন করে অত্যন্ত ভীত হয়ে কম্পিত কলেবরে কৃতাঞ্জলী পুটে প্রনাম করে গদগদভাবে অর্জুন বললেন-

অর্জুন উবাচ
স্থানে হৃষীকেশ তব প্রকীর্ত্যা
জগত্ প্রহৃষ্যতি অনুরজ্যতে চ ।
রক্ষাংসি ভীতানি দিশঃ দ্রবন্তি
সর্বে নমস্যন্তি চ সিদ্ধসঙ্ঘাঃ ।।৩৬
অর্থ-অর্জুন বললেন - হে হৃষীকেশ, তোমার মহিমা কির্তনে জগত্ প্রহৃষ্ট ও তোমার প্রতি অনুরক্ত হচ্ছে। রাক্ষসেরা ভীত হয়ে নানান দিকে পলায়ন করছে এবং সিদ্ধেরা তোমাকে নমস্কার করছে।এই সমস্তই যুক্তিযুক্ত।

কস্মাত্ চ তে ন নমেরন মহাত্মন
গরিয়সে ব্রহ্মণঃ অপি আদিকর্ত্রে
অনন্ত দেবেশ জগন্নিবাস
ত্বম অক্ষরম্‌ সদসত্ তত্ পরম্‌ যত্ ।।৩৭
অর্থ-হে মহাত্মন, তুমি ব্রহ্মার গুরু ও আদি কারণ। হে অনন্ত সকলে কেন তোমাকে নমস্কার কওেবেন না ? হে জসন্নিবাস, তুমি সত্ ও অসত্ উভয়ের অতীত তত্ত্ব,এবং সর্ব কারণের পরম কারণ।

ত্বম আদিদেবঃ পুরুষ পুরান্‌
তম্‌ অস্য বিশ্বস্য পরম নিধানম্‌ ।
বেত্তা অসি বেদ্যম চ পরম্‌ চ ধাম্‌
ত্বয়া ততম্‌ বিশ্বম্‌ অনন্তরুপ ।।৩৮
অর্থ-হে অনন্ত রুপ, তুমি আদিদেব ও অনাদি পুরুষ এবং বিশ্বের পরম আশ্রয়। তুমি সবকিছুর জ্ঞাতা, এবং তুমিই জ্ঞাতব্য। তুমিই গুণাতীত, এবং এই জগত্ তোমার দ্বারা পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে।

বায়ুঃ যমঃ অগ্নিঃ বরুনঃ শশাঙ্কঃ
প্রজাপতিঃ ত্বম্‌ প্রপিতামহঃ চ ।
নমঃ নমস্তে অস্তু সহস্র কৃতঃ
পুনঃ চ ভূয় অপি নমঃ নমস্তে ।।৩৯
অর্থ-তুমি বায়ু, যম, অগি, চন্দ্র,্ন প্রজাপতি ব্রহ্মা, অতএব তোমাকে আমি
সহস্রবার প্রনাম করি এবং পুনরায় নমস্কার করি।

নমঃ পুরস্তাত্ অত পৃষ্ঠতঃ তে
নমঃ অস্তু তে সর্বতঃ এব সর্ব ।
অনন্ত বীর্য অমিত বিক্রমঃ তমঃ
সর্বম্‌ সমাপ্নোষি ততঃ অসি সর্বঃ ।।৪০
অর্থ-হে সর্বাত্মা,তোমাকে সম্মুখে নমস্কার করছি, তোমাকে পশ্চাতে নমস্কার করছি
তোমাকে সবদিক থেকে নমস্কার করছি।হে অনন্ত বীর্য তুমি অসিম বিক্রমশালী। তুমি সমগ্র জগতে ব্যাপ্ত অতএব তুমিই সর্ব স্বরুপ।

সখা ইতি মত্বা প্রসভম্‌ যত্ উত্তম্‌
হে কৃষ্ণ হে যাদব হে সখেতি ।
অজানতা মহিমানম্‌ তব ইদম্‌
এয়া প্রমাদাত্ প্রনয়েন বা অপি ।।৪১

যত্ চ অবহাসার্থম্‌ অসত্কৃতঃ অসি
বিহার শয্যা আসন ভোজনেষু ।
একঃ অথবা অপি অচ্যুত তত্সমক্ষম্‌
তত্ ক্ষাময়ে ত্বাম অহম্‌ অপ্রমেয়ম ।।৪২
অর্থ-পুবে আমি তোমার মহিমা না জেনে তোমাকে “হে কৃষ্ণ”, “হে যাদব” “হে সখা” বলে সম্বধন করেছি। প্রমাদবসত এবং প্রনয়বসত যা কিছু করেছি তা তুমি দয়া করে ক্ষমা কর। বিহার, শয়ন ভোজনের সময়, কখনো একাকি কখনো অন্যদের সমক্ষে, আমি যে অসম্নান করেছি, সে সমস্ত অপরাধ দয়াকরে ক্ষমা কর।

পিতা অসি লোকস্য চরাচরস্য
ত্বম্‌ অস্য পূজ্যঃ চ গুরুঃ গরীয়ান ।
ন তত্সমঃ অস্তি অব্যধিকঃ কুতঃ অন্যঃ
লোকত্রয়ে অপি অপ্রতিম্‌ প্রভাব ।।৪৩
অর্থ-হে অমিতপ্রভাব, তুমি এই চরাচর জগতের পিতা, পুজ্যগুরু এবং গুরুর গুরু। অতএব, ত্রিভূবনে তোমার মত আর কেউ নাই। তোমার থেকে শ্রেষ্ঠ অন্য কে হতে পারে?

তস্মাত্ প্রণম্য প্রণিধায় কায়ম্‌
প্রসাদয়ে ত্বাম অহম্‌ ঈশম্‌ ঈড্যম্‌ ।
পিতা-ইব পুত্রস্য সখাঃ ইব সখ্যুঃ
প্রিয় প্রিয়ায়াঃ অহর্সি দেব সোঢম ।।৪৪

অদৃষ্টপুর্বম্‌ হৃষিতঃ অস্মি দৃষ্টা
ভয়েন চ প্রব্যথিতম্‌ মনঃ মে ।
তত্ এব মে দর্শয় দেব রূপম
প্রসীদ দেবেশ জগন্নিবাস ।।৪৫।
অর্থ-হে পরম পূজ্য ভগবান, তাই আমি তোমাকে তন্ডবত্ প্রনাম করে তোমার কৃপা ভিক্ষা করছি। পিতা যেমন পুত্রের, সখা যেমন সখায়, প্রিয় যেমন প্রিয়ার অপরাধক্ষমা করেন, তুমিও সেই ভাবে আমার অপরাধ ক্ষমা কর। তোমার এই বিশ্বরুপ যা পুর্বে আর ককনো দেখিনি তা দর্শন করে আমার কৌতুহল চরিতার্থ হয়েছে। তা সত্তেও আমার মন ভয়ে ব্যথিত হয়েছে। তাই হে দেবেশ, হে জসন্নিবাস, আমার প্রতি প্রসন্ন হও এবং পুনরায় তোমার সেই পুর্ব রুপই দেখাও।

কিরিটিনম্‌ গদিনম্‌ চক্রহন্তুম্‌
ইচ্ছামি ত্বাম দ্রষ্টুম্‌ অহম্‌ তথা এব ।
তেন এব রূপেন চতুর্ভুজেন
সহস্রবাহো ভব বিশ্বমুর্তে ।।৪৬
অর্থ-হে সহস্রবাহো, আমি তোমাকে সেই কিরিটি, গদা ও চক্রধারি রুপে দেখতে ইচ্ছা করি। হে বিশ্বমুর্তি এখন তুমি তোমার সেই চতুর্ভূজ মুর্তি ধারন কর।

ভগবান উবাচ
ময়া প্রসয়েন তব অর্জুন ইদম্‌
রুপম্‌ পরম্‌ দর্শিতম্‌ আত্মযোগাত্ ।
তেজময়ম্‌ বিশ্বম্‌ অনন্তম্‌ আদ্যম্‌
যত্ মে ত্বত্ অন্যেন ন দৃষ্ট পুর্বম্‌ ।।৪৭
অর্থ-ভগবান বললেন-তোমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে আমি তোমাকে জড় জগতের অন্তর্গত আত্মযোগ স্বরুপ শ্রেষ্ঠরুপ দেখালাম। তুমিছাড়া পুর্বে আর কেউই সেই অননত আদি তেজময় রুপ দেখেনি।

ন বেদ যজ্ঞ অধ্যয়নৈঃ ন দানৈঃ
ন চ ক্রিয়াভিঃ ন তপোভিঃ উগ্রৈঃ ।
এবম্‌ রূপঃ শক্যঃ অহম্‌ নৃলোকে
দ্রষ্টুম্‌ ত্বত্ অন্যেন কুরুপ্রবীর ।।৪৮
অর্থ-হে কুরুশ্রেষ্ঠ, বেদ অধ্যায়ন, যজ্ঞ, দান, পুন্যকর্ম ও কঠোর তপস্যার দ্বারা আমার এই রুপ দর্শন করতে পারে না। একমাত্র তুমিই তাই দর্শন করলে।

মা তে ব্যথা মা চ বিমূঢ়ভাব
দৃষ্টা রূপম্‌ ঘোরম্‌ ঈদৃক মম্‌ ইদম্‌ ।
ব্যপেতভীঃ প্রীতমনাঃ পুনঃ ত্বম্‌
তত্ এব মে রূপম্‌ ইদম্‌ প্রপশ্য ।।৪৯

অর্থ-আমার ভয়ঙ্কর বিশ্বরুপ দেখে তুমি ব্যাথিত হইও না। ভয় ত্যাগকরে প্রসন্ন চিত্তে আমার চতুর্ভূজ রুপ দর্শন কর।

সঞ্জয় উবাচ
ইতি অর্জুনম্‌ বাসুদেবঃ তথা উক্তা
স্বকম্‌ রুপম্‌ দর্শয়ামাস ভূয় ।
আশ্বাসয়ামাস চ ভীতম্‌ এনম্‌
ভূত্বা পুনঃ সৌম্য বপু মহাত্মা ।।৫০
অর্থ-সঞ্জয় ধৃতরাষ্টকে বললেন-মহাত্মা বাসুদেব অর্জুনকে এই ভাবে বলে তার চতুর্ভুজ রুপ দেখালেন এবং পুনরায় সৌম্য মুর্তি ধারন করে ভীত অর্জুনকে আশ্বস্ত করলেন।

দৃষ্টা ইদম্‌ মানুষম্‌ রূপম্‌ তব সৌম্যম্‌ জনার্দন ।
ইদানীম্‌ অস্মি সংবৃত্তঃ সচেতাঃ প্রকৃতিম্‌ গতাঃ ।।৫১
অর্থ-শ্রীকৃষ্ণের পরম মাধুর্যময় দ্বিভূজ মুর্তি দর্শন করে অর্জুন বললেন হে জনার্দন তোমার এই সৌম্য মানুষ মুর্তি দর্শন করে আমার চিত্ত স্থির হল এবং আমি প্রকৃতিস্ত হলাম।
ভগবান উবাচ
সুদুর্দশম্‌ ইদম্‌ রূপম্‌ দৃষ্টবানসী যত্ মম্‌ ।
দেবাঃ অপি অস্য রূপস্য নিত্যম্‌ দর্শনকাঙ্ক্ষিন ।।৫২
অর্থ-ভগবান বললেন-আমার যে রুপ দেখেছ তা অত্যন্ত দুর্লভ দর্শন। দেবতারাও এই নিত্য রুপের দর্শনাকাঙ্ক্ষি।

ন অহম্‌ বেদৈঃ ন তপসা ন দানেন ন চ ইজ্যয়া ।
শক্যঃ এবম্‌-বিধঃ দ্রষ্টুম দৃষ্টবান অসি মাম্‌ যথা ।।৫৩
অর্থ-তুমি তেমার দিব্য চক্ষু দ্বারা আমার যে রুপ দর্শন করেছ তা বেদ পাঠ,তপস্যা
দান, পুজা প্রভৃতি উপায় দ্বারা কেউই দর্শন করতে সমর্থ হয় না।

ভক্তা তু অনন্যয়া শক্যঃ অহম্‌ এবম-বিধঃ অর্জুন ।
জ্ঞাতুম্‌ দ্রষ্টুম্‌ চ তত্ত্বেন প্রবেষ্টুম্‌ চ পরন্তপ ।।৫৪
অর্থ-হে অর্জুন- অনন্যা ভক্তিদ্বারাই কেবল আমাকে জানতে ও স্বরুপত প্রত্যক্ষ করতে এবং আমার চিন্ময় ধামে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়।

মত্কর্মকৃত্ মত্পরম্‌ মদ্ভক্তঃ সঙ্গবর্জিতঃ ।
নির্বৈরঃ সর্ব ভূতেষু যঃ সঃ মাম্‌ এতি পান্ডবা ।।৫৫
অর্থ-হে অর্জুন- যিনি আমার অকৈতব সেবা করেন, আমার প্রতি নিষ্ঠাপরায়ন, আমার ভক্ত,জড় বিষয়ে সম্পুর্ণ আসক্তি রহিত এবং সম প্রাণীর প্রতি শত্রুভাব রহিত তিনি অবশ্যই আমার কাছে ফিরে আসবে।